সর্বশেষ

6/recent/ticker-posts

Ad Code

ইউনূসের দাবি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভুয়া; তবে তথ্য বলছে ভিন্ন কথা

 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিতর্কিত মন্তব্য এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডাভোস) মঞ্চে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে "ভুয়া" বলে অভিহিত করে একটি বিতর্কিত দাবি করেন। তার এই মন্তব্য দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবে বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর মতো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপরীত চিত্র উপস্থাপন করে। এসব নির্ভরযোগ্য উৎসের তথ্যে দেশটির স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা যায়, যা বৈশ্বিক নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও অর্জিত হয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংকের দৃষ্টিকোণ

বিশ্ব ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম অগ্রসরমান অর্থনীতির একটি উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশটি গড়ে বার্ষিক ৬.৪% হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যেখানে ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৭.৮%-এ পৌঁছেছিল। রপ্তানি-কেন্দ্রিক নীতি, শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা, এবং দারিদ্র্য হ্রাস কর্মসূচি এই প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প (RMG) দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি মোট রপ্তানির ৮৫% অবদান রাখার পাশাপাশি লক্ষাধিক শ্রমিক, বিশেষ করে নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে।

সামাজিক অগ্রগতির প্রতিফলন

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক অগ্রগতিও সমানভাবে অর্জিত হয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১.৫%, তা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৮%-এ। গড় আয়ু ৬৯ বছর থেকে বেড়ে ৭৩ বছরে পৌঁছেছে, আর প্রাথমিক শিক্ষার হার প্রায় সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। এসব অগ্রগতি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বাস্তবতাকে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরে।

IMF-এর মূল্যায়ন

IMF-এর তথ্য অনুসারে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল মাত্র ৬৮৬ ডলার, যা ২০২২ সালে বেড়ে ২,৬৮৮.৩০ ডলারে পৌঁছেছে—এক দশকের মধ্যে প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি। এই উন্নয়ন বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরকে প্রতিফলিত করে। এটি কেবলমাত্র পরিসংখ্যান নয়; বরং লাখ লাখ মানুষের জীবনমানের বাস্তব পরিবর্তনের নিদর্শন।

IMF আরও উল্লেখ করে, বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অর্জনের মূলে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব ঘাটতির সীমিতকরণ, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি। ২০২১ সালে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

সমালোচনা ও বাস্তবতা

ড. ইউনূসের মন্তব্য দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিসংখ্যান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনকে চ্যালেঞ্জ করে। তবে এসব সংস্থা তাদের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সরকারি রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে না। তারা স্বাধীন গবেষণা, তৃতীয় পক্ষের অডিট, এবং স্যাটেলাইট-ভিত্তিক অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের তথ্য যাচাই করে।

ড. ইউনূসের সমালোচকরা মনে করেন, তার এই মন্তব্য দেশের সাফল্যকে খাটো করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারে। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংক খাতের ঋণ সমস্যা এবং রপ্তানি খাতের অতিরিক্ত নির্ভরতার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কিন্তু এগুলো কোনোভাবেই দেশের সামগ্রিক অর্জনকে অস্বীকার করে না।

শেষ কথা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিখুঁত নয়, তবে তা ভুয়া বলার মতোও নয়। এটি সাফল্য ও চ্যালেঞ্জের একটি জটিল মিশ্রণ। বিশ্ব ব্যাংক এবং IMF-এর তথ্য ড. ইউনূসের দাবির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করে, যা দেশের অর্থনৈতিক অর্জনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে সমর্থন করে। দেশের সাফল্যকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে।

Post a Comment

0 Comments