বিএনপি জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরিপ্রেক্ষিতে 'জাতীয় ঐকমত্যের রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র' এর খসড়া প্রস্তুত করেছে এবং এটি নিয়ে তাদের আন্দোলনের শরিক দলগুলোর মতামত গ্রহণ শুরু করেছে। গত শুক্রবার গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ১২ দলীয় জোট এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ খসড়া উপস্থাপন করা হয়। দলটি জানিয়েছে, শরিক দলের মতামত নেওয়ার পরই চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, খসড়ার ব্যাপারে সমমনা দলগুলোর মতামত নেওয়ার পরই এটি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা ঘোষণাপত্রে সাইন করবেন এবং এটি জনগণের কাছে উপস্থাপন করা হবে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিএনপি এই ঘোষণাপত্রটি সমমনা দলগুলোর সম্মতিতে প্রকাশ করবে এবং অন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীকে এর বাইরে রাখবে না।
খসড়ায় ১৮ দফায় বিভক্ত ঘোষণাপত্রে বর্তমান সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুম, খুন, হত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের অপরাধের বিচার দাবি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া, এতে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সংগঠন সমর্থন জানাবে বলে জানা গেছে। এর আগে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতা ও জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিরা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়ে সরকারের কাছে আশ্বাস পেয়েছিলেন। তবে পরে তারা এই উদ্যোগ থেকে বিরত হন, এবং সরকারও সব রাজনৈতিক দলকে এই ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনার জন্য আহ্বান জানায়।
বিএনপির একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো, তারা জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় দেশের স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। ২৫ দফায় এই খসড়া দেওয়া হলে, স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক বন্দোবস্ত পরিবর্তন এবং নতুন জনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সহ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে অভিপ্রায় প্রকাশ করা হয়।
বিএনপি খসড়ায় সুশাসন, সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন, এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিদ্যমান সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কারের কথা উল্লেখ করেছে। তাদের অভিযোগ, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ১৬ বছর ধরে একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি করেছে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পরিপন্থী কাজ করেছে।
এছাড়া, ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অত্যাচার, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও আনা হয়েছে এবং এসব অপরাধের দ্রুত বিচার দাবি করা হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, ফ্যাসিবাদী শাসন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং দেশের অবস্থা আরও সংকটময় হতে পারে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সরকারি দমন-পীড়নের ফলে দেশে ব্যাপক গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং তা এক বৃহৎ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এতে ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, শ্রমিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি এখন ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করার কাজ করছে এবং শরিক দলের মতামত নেওয়ার মাধ্যমে এটি আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জানিয়েছেন, সরকার তাদের মতো করে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেছে এবং বিএনপি এখন তাদের মতামত নিয়ে তা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। তিনি জানান, খুব শিগগিরই খসড়া সরকারকে প্রদান করা হবে।
বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "যেহেতু ছাত্ররা একটি জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি করেছিল, আমরাও আমাদের খসড়া প্রস্তুত করেছি। এটা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।" তিনি আরও বলেন, এই ঘোষণাপত্র একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু এর সাংবিধানিক ও আইনি গুরুত্ব নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
বিএনপির এই উদ্যোগ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একদিকে যেমন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি সরকার বিরোধী পক্ষের শক্তি একত্রিত হয়ে এই ঘোষণাপত্রকে সামনে নিয়ে আসছে।
0 Comments